জয়ে ফেরা হল না ইস্টবেঙ্গল এফসি-র। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের ঘরের মাঠে তাদের কাছে হারল লাল-হলুদ বাহিনী। টানা ছয় ম্যাচে অপরাজিত থাকার পর ফের হার মানতে হল তাদের। অন্য দিকে, ইস্টবেঙ্গলকে ৩-২-এ হারিয়ে টানা আট ম্যাচে জয়ের খরা কাটাল নর্থইস্ট ইউনাইটেড। সদ্য তাদের দলে যোগ দেওয়া অস্ট্রেলীয় ফরোয়ার্ড টমি জুরিক ও স্প্যানিশ মিডফিল্ডার নেস্টর আলবিয়াখই এ দিন গুয়াহাটির দলকে দীর্ঘ অপেক্ষার পর জয় এনে দেন। নন্দকুমার শেখর ও নবনিযুক্ত জার্মান ফরোয়ার্ড ফেলিসিও ব্রাউন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে ব্যবধান কমালেও শেষ পর্যন্ত সমতা আনতে বা জেতাতে পারেননি তাঁরা।
কলকাতা ডার্বি এক সপ্তাহ আগে হয়ে গেলেও এ দিন ইস্টবেঙ্গলের পারফরম্যান্স দেখে মনে হয় ডার্বির ‘হ্যাঙওভার’ তাদের এখনও কাটেনি। বিশেষ করে তাদের রক্ষণ এ দিন অপ্রত্যাশিত ভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই দু’গোলে পিছিয়ে যায় লাল-হলুদ বাহিনী। দ্বিতীয়ার্ধে নন্দ ও ব্রাউন ব্যবধান কমালেও জুরিককে ধরে রাখতে পারেননি তাঁদের সতীর্থ ডিফেন্ডাররা। দ্বিতীয় গোল করে দলকে চলতি লিগের তৃতীয় জয় এনে দেন। এই জয়ের ফলে ১৬ পয়েন্ট নিয়ে লিগ তালিকায় ছ’নম্বরে উঠে এল তারা। চার নম্বর হারের ফলে লিগ তালিকায় নয়ে নেমে গেল ইস্টবেঙ্গল এফসি।
চলতি লিগে ইস্টবেঙ্গল শেষ জয় পেয়েছিল এই নর্থইস্টের বিরুদ্ধেই। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাদের ৫-০-য় হারিয়েছিল লাল-হলুদ বাহিনী, যা ছিল আইএসএলে তাদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়। তার পর থেকে জয়ের খরা দেখা দিয়েছে কার্লস কুয়াদ্রাতের শিবিরে। শুধু হার নয়, এ দিন আরও একটি ক্ষতি হল তাদের। এই ম্যাচে হলুদ কার্ড দেখায় মঙ্গলবার মুম্বই সিটি এফসি-র বিরুদ্ধে পরবর্তী কঠিন ম্যাচে খেলতে পারবেন না ক্লেটন সিলভা। যা তাদের আরও পিছিয়ে দিতে পারে।
ডার্বিতে খেলা প্রথম দলে এ দিন একটিমাত্র পরিবর্তন করে ইস্টবেঙ্গল। সল ক্রেসপোর জায়গায় নামেন সায়ন ব্যানার্জি। এ দিন ৫০তম আইএসএল ম্যাচে নেমেছিলেন নাওরেম মহেশ সিং। ইস্টবেঙ্গলের কোনও খেলোয়াড় এই প্রথম এই মাইলস্টোন গড়লেন। কিন্তু সেই ম্যাচ স্মরণীয় হল না। ম্যাচের শুরুতে দু-তিন মিনিট ইস্টবেঙ্গল আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করলেও তার পর থেকেই আক্রমণের ধার বাড়াতে শুরু করে নর্থইস্ট এবং চার মিনিটের মাথায় গোলও পেয়ে যায়। সায়নের মিসপাস থেকে বল পেয়ে বাঁ দিক দিয়ে ওঠেন জিথিন এমএস। বক্সের সামনে নেস্টর আলবিয়াখকে বল দেন তিনি। নেস্টর স্কোয়ার পাস দেন গোলের সামনে টমি জুরিকের কাছে। গোলে বল ঠেলতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি জুরিক (১-০) ।
এই গোলের সময় ইস্টবেঙ্গলের তিন ডিফেন্ডার লালচুঙনুঙ্গা, হিজাজি মাহের ও হোসে পার্দো থাকলেও জিথিন, নেস্টর বা জুরিক, তিনজনই কার্যত অরক্ষিত ছিলেন। এ লিগে মেলবোর্ন ভিকট্রি থেকে জানুয়ারির দলবদলে সদ্য ভারতে পা রেখেছেন ৩২ বছর বয়সী জুরিক। এসেই নিজেকে উজ্জ্বল করে তুললেন তিনি।
এ দিন ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণকে খুবই জড়সড় ও আগোছালো লাগে। ডার্বির পরে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ছাপ যেন পাওয়া যাচ্ছিল তাদের পারফরম্যান্সে। সেকেন্ড বল ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়েই ছিল তারা। সারা মাঠ জুড়ে খেলতে দেখা যায় জিথিনকে। কিন্তু তাঁকে কড়া পাহাড়ায় রাখার চেষ্টা দেখা যায়নি।
রক্ষণের এই দুর্বলতার মাশুল তাদের ফের দিতে হয় ১৫ মিনিটের মাথায়। এ বার সেন্টার লাইনের ওপার থেকে আসা বল নিয়ে বক্সে ঢুকে বক্সের ডানদিকের কোণ থেকে গোলের সামনে নেস্টরের কাছে থ্রু পাঠান রিদিম তলাঙ। কোনও ঝুঁকি না নিয়ে প্রথম টাচেই জালে বল জড়িয়ে দেন নেস্টর (২-০)। এ বারও লালচুঙনুঙ্গা ছিলেন নেস্টরের কাছেই। কিন্তু তিনি তাঁকে আটকাতে পারেননি। ২৪ মিনিটের মাথায় রেফারির সঙ্গে অযথা তর্ক করে হলুদ কার্ড দেখেন ক্লেটন সিলভা, যার ফলে তিনি পরের ম্যাচে খেলতে পারবেন না।
প্রথমার্ধে যেখানে গোলে দুটি শট নেয় নর্থইস্ট, সেখানে ইস্টবেঙ্গল একটির বেশি শট টার্গেটে রাখতে পারেনি। ম্যাচের শেষে অবশ্য এই পরিসংখ্যান দাঁড়ায় ৪-৪। লক্ষ্যভ্রষ্ট শটও তিনটির বেশি ছিল না লাল-হলুদের। সারা অর্ধে যেখানে আটটি ক্রস দেন নর্থইস্টের খেলোয়াড়রা, সেখানে তিনটির বেশি ক্রস দিতে পারেননি নন্দকুমার, মহেশরা। দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য তারা আরও দশটি ক্রস দেন।
৩২ মিনিটের মাথায় প্রথম গোলে শট নেয় ইস্টবেঙ্গল। বক্সের সামনে বাঁ দিক থেকে দূরপাল্লার শট নেন সায়ন। কিন্তু তা যায় সোজা গোলকিপার মিরশাদ মিচুর হাতে। কিন্তু দুর্দান্ত দুই গোলের পর অসাধারণ রক্ষণও দেখা যায় নর্থইস্টের। প্রথমার্ধের বাড়তি সময়ে ক্লেটনের দূরপাল্লার শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। প্রতিপক্ষের গোলের ধারেকাছে বিশেষ ঘেঁষতে পারেনি তারা।
দ্বিতীয়ার্ধে দুটি পরিবর্তন করে দল নামান ইস্টবেঙ্গল কোচ কার্লস কুয়াদ্রাত। মন্দার রাও দেশাই ও বিষ্ণু পুথিয়া নামেন নিশু কুমার ও হোসে পার্দোর জায়গায়। ৪৭ মিনিটের মাথায় ফের একটি গোলের সুযোগ তৈরি করে নেয় নর্থইস্ট, যখন ডানদিক থেকে তলাঙের ক্রসে হেড করেন জিথিন। ছগজের বক্সে জুরিক থাকলেও হেড করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারান জিথিন। ফলে বল গোলের বাইরে চলে যায়।
ইস্টবেঙ্গল খেলায় ফিরে আসার মরিয়া চেষ্টা শুরু করে ৫০ মিনিটের পর থেকে এবং তাদের প্রথম সাফল্য আসে ৫৩ মিনিটের মাথায়, যখন ব্যবধান কমান নন্দকুমার শেখর। এই গোলেই প্রথম লাল-হলুদ বাহিনীর খেলায় পরিকল্পনার ছাপ দেখা যায়। পাঁচ পাসে তৈরি মুভের ফসল এই গোল। মাঝমাঠের ডানদিক থেকে শুরু হওয়া এই আক্রমণের শেষে নন্দকুমারকে গোলের পাস বাড়ান ক্লেটন। অনেকটা সময় ও জায়গা পেয়ে বক্সে ঢুকে সোজা গোলে শট নেন নন্দকুমার (২-১)।
ব্যবধান কমানোর পর থেকে ইস্টবেঙ্গল আক্রমণে যেমন তৎপরতা বাড়ে, তেমনই ব্যবধান বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে নর্থইস্টও। ফলে এই সময়ে ম্যাচ জমে ওঠে। সমতা আনার উদ্দেশ্যে ৬৩ মিনিটের মাথায় সায়নের জায়গায় সদ্য দলে যোগ দেওয়া জার্মান ফরোয়ার্ড ফেলিসিও ব্রাউন ফোর্বস্-কে নামায় ইস্টবেঙ্গল।
কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়ে ব্যবধান ফের বাড়িয়ে নেন নর্থইস্টের নতুন বিদেশি ফরোয়ার্ড জুরিক। অসাধারণ এই গোলের কৃতিত্ব বেশিরভাগটুকুই অস্ট্রেলীয় তারকার। মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বল বুক দিয়ে নামিয়ে বক্সের ডান কোণের সামনে থেকে কোণাকুনি শট নেন তিনি, যা দ্বিতীয় পোস্টের দিকে ওপরের কোণ দিয়ে গোলে ঢুকে যায় (৩-১)। চেষ্টা করেও জুরিককে কোনও ভাবে আটকাতে পারেননি মহম্মদ রকিপ।
৭১ মিনিটের মাথায় নেস্টরকে তুলে মরক্কোর ডিফেন্ডার হামজা রেগরাগুইকে নামান নর্থইস্ট কোচ হুয়ান বেনালি। উদ্দেশ্য নিজেদের দূর্গের সামনে দুর্ভেদ্য প্রাচীর তৈরি করা। যদিও তাদের আক্রমণের ঘনঘটা চলতেই থাকে এবং ব্যবধান বাড়ানোর আরও সুযোগ তৈরি করে নর্থইস্ট, যার বেশিরভাগেই জিথিনের ভূমিকাই ছিল প্রধান।
ইস্টবেঙ্গলের আরও এক নতুন বিদেশী খেলোয়াড় ভিক্টর ভাজকেজ নামেন ৭৬ মিনিটের মাথায়, অজয়. ছেত্রীর জায়গায় এবং তাঁর আগমনের মাত্র ছ’মিনিটের মধ্যে ফের ব্যবধান কমান ফেলিসিও ব্রাউন। যদিও এই গোলের বেশিরভাগ কৃতিত্বই প্রাপ্য ক্লেটন সিলভার।
বাঁ দিকের উইং থেকে আসা উড়ন্ত ক্রস পেয়ে তিনি দুই ডিফেন্ডারকে ধোঁকা দিয়ে বক্সের ডানদিক থেকে গোলে কোণাকুনি শট নেন, যা গোল লাইনে থাকা নর্থইস্ট অধিনায়ক মিগুয়েল জাবাকোর গায়ে লেগে ছিটকে আসে। জাবাকোর সামনে থাকা সুযোগসন্ধানী ব্রাউন বল গোলে পাঠিয়ে দেন (৩-২)। এটিই চলতি আইএসএলের দু’শোতম গোল।
ব্যবধান কমে যাওয়ায় রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার রোমেন ফিলিপোতো ও তরুণ ফরোয়ার্ড পার্থিব গগৈকে নামায় নর্থইস্ট। তুলে নেওয়া হয় জুরিককে। ইস্টবেঙ্গলও শেষ মিনিটে নামায় ভিপি সুহেরকে। আট মিনিটের বাড়তি সময়ে গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে দুই দলই। নাগাড়ে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে আক্রমণ হতে থাকে। কিন্তু দুই দলেরই দুর্ভ্দ্যে রক্ষণের প্রাচীরে চিড় ধরাতে পারেননি কেউই।
ইস্টবেঙ্গল এফসি দল (৪-৪-২): প্রভসুখন গিল (গোল), মহম্মদ রকিপ, লালচুঙনুঙ্গা (ভিপি সুহের-৯০), হিজাজি মাহের, নিশু কুমার (মন্দার রাও দেশাই-৪৫), সায়ন ব্যানার্জি (ফেলিসিও ব্রাউন-৬৩), হোসে পার্দো (বিষ্ণু পুথিয়া-৪৫), অজয় ছেত্রী (ভিক্টর ভাস্কেজ-৭৬), নন্দকুমার শেখর, ক্লেটন সিলভা, নাওরেম মহেশ সিং।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: নর্থইস্ট ইউনাইটেড এফসি ৩২.৬% – ইস্টবেঙ্গল এফসি ৬৭.৪%, সফল পাসের হার: ৬৬%-৮৩%, গোলে শট: ৪-৪, ফাউল: ৮-১২, ইন্টারসেপশন: ১৭-৫, ক্রস: ১৫-১৩, কর্নার: ৪-২, হলুদ কার্ড: ২-২।
ম্যাচের সেরা: টমি জুরিক (নর্থইস্ট ইউনাইটেড)