গত চার ম্যাচে জয়হীন থাকার পরে অবশেষে সাফল্যের মুখ দেখল মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। শনিবার তারা ঘরের মাঠে লিগ টেবলে সবার নীচে থাকা হায়দরাবাদ এফসি-কে ২-০-য় হারিয়ে লিগ টেবলে উঠে এল চার নম্বরে। অনিরুদ্ধ থাপা ও জেসন কামিংসের গোলে এ দিন জেতে গতবারের কাপ চ্যাম্পিয়নরা। তবে হায়দরাবাদের তরুণ ফুটবলাররা দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলায় ব্যবধান আর বাড়াতে পারেননি দিমিত্রিয়স পেট্রাটস, জেসন কামিংসরা।
তরুণ ফুটবলারে ভরা হায়দরাবাদ এফসি-কে দুর্বল দল বলে মনে করা হলেও শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে যে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় পুরোপুরি দেশীয় তরুণ ফুটবলার ও সাপোর্ট স্টাফে গড়া দলটি, তার পরে তাদের দুর্বল মনে করাটা বোধহয় বোকামিই হবে। প্রথমার্ধে মোহনবাগান আধিপত্য বিস্তার করলেও দ্বিতীয়ার্ধে তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেন মহম্মদ রফি, আব্দুল রাবি-রা। যেমন রক্ষণ, তেমন গোলরক্ষা ও তার চেয়েও ধারালো প্রতি আক্রমণ। কিন্তু খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতার অভাবই এ দিন তাঁদের গোল করার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে মোহনবাগানকে এ দিন কোনও বিপদে পড়তে হয়নি।
ডার্বির দলে পাঁচটি পরিবর্তন করে এ দিন প্রথম এগারো নামান মোহনবাগান কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। অমনদীপ ভান, মনবীর সিং, অভিষেক সূর্যবংশী, গ্ল্যান মার্টিন্স ও জেসন কামিংস দলে আসেন। অন্যদিকে, দলের একমাত্র বিদেশী ও ক্যাপ্টেন জোয়াও ভিক্টরকে এ দিন বাইরে রেখেই দল নামায় হায়দরাবাদ এফসি।
প্রত্যাশিত ভাবেই তথাকথিত দুর্বল প্রতিপক্ষকে শুরু থেকেই চাপে রাখে মোহনবাগান এসজি। তিন ব্যাকে দল সাজিয়ে, আক্রমণে বেশি খেলোয়াড় রেখে ম্যাচ শুরুর আগে সে রকমই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিল তারা। গোটা দলটাই কার্যত উঠে যায় প্রতিপক্ষের অর্ধে এবং ১৩ মিনিটের মাথাতেই গোল করে এগিয়েও যায় তারা।
কর্নার কিকে দিমিত্রিয়স পেট্রাটস গোলের সামনে বল পাঠালে তা গোলের দিকে ফ্লিক করেন মনবীর সিং। কিন্তু তা গোল লাইনে থাকা এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে সামনে ছিটকে আসে। সামনেই ছিলেন অনিরুদ্ধ থাপা। তিনি বল গোলে ঠেলতে কোনও ভুল করেননি (১-০)।
শুরুতেই এগিয়ে যাওয়ায় আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বাড়াতে থাকে মোহনবাগান। কিন্তু তাদের হাইলাইন ফুটবলের প্রবণতা হায়দরাবাদের তরুণ ফুটবলারদের প্রতি আক্রমণের রাস্তা খুলে দেয়। তারা সেই সুযোগ কাজে লাগানোরও চেষ্টা করে। ১৯ মিনিটের মাথায় বিপজ্জনক ভাবে বাগানের বক্সে ঢুকে পড়েন রামলুনচুঙ্গা। কিন্তু রক্ষণের খেলোয়াড়দের ভীড়ে আটকা পড়ে যান তিনি।
২৪ মিনিটের মাথায় ফের বক্সের মধ্যে ঢুকে গোলে শট নেন রামলুনচুঙ্গা। যা সেভ করেন বিশাল কয়েথ। তবে তাঁর হাত থেকে ছিটকে বল চলে আসে আব্দুল রাবির সামনে। তিনি ঠিকমতো তাতে পা লাগাতে পারলে বিপদে পড়ত মোহনবাগান। এ দিন বারবার প্রতিপক্ষের রক্ষণের বিপদ বাড়ান রামলুনচুঙ্গা। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে তিনি আসল কাজটি করতে পারেননি। ৩১ মিনিটের মাথায় বক্সের মাথা থেকে ফের এক শট নেন, যা গোলের বাইরে চলে যায়। ৩৭ মিনিটের মাথায় ডানদিক থেকে অসাধারণ একটি ক্রস দেন মাকান চোথে, যার উদ্দেশ্য ছিল জোসেফ সানি। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগেই এগিয়ে এসে বলের দখল নিয়ে নেন বিশাল।
এ দিন দ্বিতীয় গোলটি করলেও জেসন কামিংসের পারফরম্যান্স সামগ্রিক ভাবে মন ভরাতে পারেনি দর্শকদের। ২৮ মিনিটের মাথায় যে দূরপাল্লার শটটি গোলে মারেন তিনি, তাতে তেমন গতিই ছিল না। গোলকিপার গুরমিতের সেই বল আটকাতে কোনও অসুবিধাই হয়নি। পরের মিনিটেই সহাল বিপক্ষের বক্সে ঢুকে কাটব্যাক করেন। কিন্তু দুই অস্ট্রেলিয়ান একই লাইনে চলে আসায় তাঁরা কেউই বলে পৌঁছতে পারেননি। ৩৪ মিনিটের মাথায় শুভাশিসের কাছ থেকে বল পেয়ে মনবীর বক্সে ঢুকে কামিংসের উদ্দেশ্যে কাটব্যাক করলেও তিনি বলে পৌঁছবার আগে বল ক্লিয়ার করে দেন হায়দরাবাদের ডিফেন্ডাররা।
হায়দারাবাদের তরুণ ফুটবলাররা যে রকম প্রায়ই আক্রমণ শুরু করেন, তাতে তিন পয়েন্ট সুরক্ষিত করার জন্য আরও একটি গোল প্রয়োজন ছিল মোহনবাগানের। সেই গোলটি অবশেষে করেন কামিংসই। প্রথমার্ধের স্টপেজ টাইমে মনবীরের নিখুঁত কাটব্যাকে পাওয়া বল প্রথম টাচেই গোলে পাঠিয়ে দেন অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপার (২-০)। এ রকম গোলের সুযোগ এ দিন আরও তৈরি করেন মনবীর। নিজেও গোলের সুযোগ পান। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য যে, কোনও গোল করতে পারেননি। তবে ম্যাচের সেরার পুরস্কারটা অবশ্যই তাঁরই প্রাপ্য ছিল এবং পানও।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে ২০ বছর বয়সী ডিফেন্ডার দীপ্পেন্দু বিশ্বাসকে নামান কোচ হাবাস। এই প্রথম আইএসএলে সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে নামতে দেখা যায় তাঁকে। গ্ল্যান মার্টিন্সের জায়গায় নামেন তিনি। তবে মোহনবাগান ফের শুরু থেকেই চাপে রাখে প্রতিপক্ষকে। তবে এই অর্ধে হায়দরাবাদের রক্ষণ ছিল যথেষ্ট সঙ্ঘবদ্ধ ও দুর্ভেদ্য। অমনদীপের জায়গায় নামা কিয়ান, পেট্রাটস, মনবীর, কামিংসদের একাধিক চেষ্টা আটকে দেন মহম্মদ রফি, সাজ্জাদ হুসেন, অ্যালেক্স সাজি, জেরেমিরা। এঁরা ছাড়াও দলের ফরোয়ার্ড, মিডফিল্ডাররাও প্রয়োজনে প্রায়ই নেমে এসে দূর্গ সামলান। অসাধারণ রক্ষণ ছাড়াও প্রতি আক্রমণেও মরিয়া হয়ে ওঠে তারা।
গোলকিপার গুরমিতও এ দিন ছিলেন দুর্দান্ত। ৫৬ মিনিটে পরপর দু’বার পেট্রাটস ও কিয়ানকে অবধারিত গোলের শট আটকে দেন তিনি। ৭১ মিনিটে কিয়ানের জোরালো শট ফের রুখে দেন গুরমিত। ৮৬ মিনিটের মাথায় ডানদিক দিয়ে বক্সে ঢোকা মনবীরের মাটি ঘেঁষা শটও দুর্দান্ত সেভ করেন তিনি। ছ’মিনিটের বাড়তি সময়ে ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে মনবীরের শটও আটকে দেন গুরমিত।
সহাল গোলে একাধিক লক্ষ্যভ্রষ্ট শট নেওয়ার পর ৬১ মিনিটের মাথায় জনি কাউকোকে জায়গা করে দিতে মাঠ ছাড়েন। এ দিন ম্যাচের আগেই হুগো বুমৌসকে ছেড়ে দিয়ে কাউকোকে মরশুমের শেষ পর্যন্ত রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় মোহনবাগান। সেই কাউকো এ দিন বহু মাস পর মাঠে নেমে অবশ্য খুব একটা ছন্দে ছিলেন না। ৬৫ মিনিটের মাথায় মনবীরের একটি কাট ব্যাক তাঁর পায়ে এলে তিনি যে স্লাইস করেন, তা খুবই দুর্বল ছিল। বহু দিন পর যে ম্যাচে নেমেছেন, তা বোঝাই গেল।
তবে তিনি মাঠে নামার পরে মোহনবাগান দলের চেহারা যে ভাবে পাল্টে যায়, তাতে বোঝা যায় দলে যে একজন যোগ্য নেতার প্রয়োজন ছিল, কাউকোর মধ্যেই সেই নেতাকে খুঁজে পেয়েছেন কিয়ানরা। কাউকোর এই প্রভাব এফসি গোয়ার বিরুদ্ধে পরের ম্যাচে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
মোহনবাগান এসজি দল (৩-১-৪-২): বিশাল কয়েথ (গোল), গ্ল্যান মার্টিন্স (দীপ্পেন্দু বিশ্বাস-৪৫), হেক্টর ইউস্তে, শুভাশিস বোস, অভিষেক সূর্যবংশী, মনবীর সিং, অনিরুদ্ধ থাপা (লালরিনলিয়ানা হ্নামতে-৮৩), সহাল আব্দুল সামাদ (জনি কাউকো-৬১), অমনদীপ ভান (কিয়ান নাসিরি-৩২), জেসন কামিংস, দিমিত্রিয়স পেট্রাটস (সুহেল ভাট-৮৩)।
পরিসংখ্যানে ম্যাচ
বল পজেশন: মোহনবাগান এসজি ৫৮.৯% – হায়দরাবাদ এফসি ৪১.১%, সফল পাসের হার: ৮২%-৭৪%, গোলে শট: ১৩-৪, ফাউল: ১১-২, ইন্টারসেপশন: ১১-৭, ক্রস: ১৪-১৪, কর্নার: ৯-৬, হলুদ কার্ড: ১-০।
ম্যাচের সেরা: মনবীর সিং (মোহনবাগান এসজি)