১৯২৫ সালের ২৮ শে মে, বৃহস্পতিবার, দুপুর ১২ টা। তৎকালীন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সেক্রেটারি বনোয়ারীলাল রায়ের সুবৃহৎ গাড়িটা গিয়ে থামলো হাওড়ার রেল অফিসের গেটে। ওখান থেকেই গাড়িতে উঠে পড়লেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের তিনজন খেলোয়াড় – পূর্ণ দাস, সূর্য চক্রবর্তী আর হারান সাহা। লক্ষ্য ময়দান। কারণ সেদিনই কলকাতা লীগের খেলায় প্রথম সাক্ষাৎ হতে চলেছে ইস্টবেঙ্গলের সাথে মোহনবাগানের। এর আগেও গোটা দুই তিন বার দুই দলের সাক্ষাৎ হয়েছিল, কিন্তু এটা একটু অন্য ধরণের, অন্য উচ্চতায়। কারণ, এটা কলকাতা প্রথম ডিভিশন লিগে প্রথম সাক্ষাৎকার উভয় দলের মধ্যে। তাই এই ম্যাচের ব্যাপারে সাধারণ দর্শকদের মধ্যে আবেগ আর উন্মাদনা ছিল চোখে পরার মতো। খেলার দিন দুই আগে থেকেই ইংরেজি দৈনিকগুলোর প্রচারিত সংবাদে দর্শকদের মধ্যে বেশ ভালো রকম সাড়া পরে যায়। তাই খেলার আগের দিনই সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। টিকিটের ব্যাপারটাও লক্ষ্যনীয় ছিল। চার আনার টিকিটে কয়েক ধাপ গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে লোকে খেলা দেখতো। আর আনা আটেক খরচ করলে মাঠের ধারে লোহার বেঞ্চিতে বসে খেলা দেখার ব্যবস্থা ছিল। ক্যালকাটা মাঠের (এখন যেটা মোহনবাগান, ক্যালকাটা ক্লাবের মাঠ) পশ্চিম দিকে মূলত সাহেবরা বসতো। আর তার ডানদিকে ছিল সদস্যদের বসার জায়গা।

এই খেলা প্রসঙ্গে বলতে গেলে একটু পিছন দিকে তাকানো যাক। মূলত “বাঙাল ঘটি” বিষয়টিকে নিয়ে। এমনিতেই তখনকার সময়ে পদ্মার ওপার থেকে কলকাতায় আসা মানুষদের ভাষা, আচার ব্যবহার নিয়ে এখানকার মানুষদের বিদ্রুপ তো ছিলই, আর সেটা যেন আগুনে ঘি পড়লো, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠাতা সুরেশ চৌধুরীকে জোড়াবাগান ক্লাবের কমিটি থেকে বলা বিদ্রুপাত্মক কথায়। সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী তখন জোড়াবাগান ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট। একদিন আগেই সেই ক্লাবের হয়ে একটি খেলায়, খারাপ খেলার অজুহাতে শৈলেশ বসু আর নসা সেনকে ক্লাব কর্তৃপক্ষ খুব খারাপ ভাবে অপমান করে। ক্লাবের মিটিংয়ে কেউ একজন সুরেশ চন্দ্র চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বিদ্রুপ করে বলেন “বাঙালদের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে না রাখাই ভালো”। এমন অপমানজনক কথা শুনতে সুরেশ চৌধুরী কখনোই প্রস্তুত ছিলেন না। যে ক্লাবকে ভালোবেসে হাজার হাজার টাকা ক্লাবের উন্নয়নে দিয়েছেন, সেই ক্লাবের পক্ষ থেকে এমন কথা…পরের দিনই তিনি শৈলেশ বসু আর নসা সেনকে নিয়ে তৈরী করলেন একটি নতুন ক্লাব। মূল নীতি ছিল, সেই ক্লাবে খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সবাই একসূত্রে আবদ্ধ থাকবে, থাকবেনা কোনো ভেদাভেদ, সবার সঠিক সম্মান বজায় থাকবে। যার নাম হলো “ইস্টবেঙ্গল ক্লাব”।

মূলত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হাত ধরেই তখনকার দিনের অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষেরা তাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষা করতে শিখলো। জবাব দেওয়ার মাধ্যম খুঁজে পেলো। ফলাফল খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে গেলো ১৯২৪ সালের কোচবিহার কাপ খেলায়। বিভিন্ন জায়গায় লেখা একটা শিরোনামও তখন বেশ নজর ফেলেছিলো, “আই.এফ.এ. শিল্ড বিজয়ী অতি গর্বের মোহনবাগানের পরাজয় – বাঙালদের টিমের কাছে হার”। এবারে লীগের খেলায় একেবারে সামনাসামনি লড়াই। দুই দলেরই সম্মান রক্ষার লড়াই।

খেলার আগেই বনোয়ারীলাল রায় ঘোষণা করেছিলেন ম্যাচ জিতলেই বিরাট করে ভুড়ি ভোজের আয়োজন করা হবে। খবরটা সবার মনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিলো। আসলে তখন প্লেয়াররা ক্লাবে খেলার সুবাদে কোনো পারিশ্রমিক পেতেন না। ভালো খেললে হাফটাইমের সময় একটার জায়গায় দুই বা তিনটে লেমনেড খাওয়ার স্বাধীনতা, খেলার শেষে গাছতলার নিচে মালিদের ক্যান্টিনে একটা টোষ্ট, অল্প আলুর দম বা কপাল ভালো থাকলে একটি কলা আর একটি ডিমসেদ্ধ … ব্যাস এই ছিল ক্লাবের থেকে পাওনা। আর অধিনায়ক হলে ক্লাবের জার্সি বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা ছিল। এতো কিছু পাওয়া–না পাওয়ার পরেও একটাই আনন্দ ছিল, সেটা হলো ক্লাবের জয়। আর সেটার জন্য খেলার মাঠে নিজের জীবন দিতেও খেলোয়াড়রা পিছুপা হতেন না।

সেদিনের খেলায় ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে যে এগারোজন খেলেছিলেন তারা ছিলেন :
গোলে : পূর্ণ দাস।
ব্যাক : প্রফুল্ল চ্যাটার্জি ও সন্তোষ গাঙ্গুলি।
হাফব্যাক : হারান সাহা, ননী গোসাই ও বিজয়হরি সেন।
ফরওয়ার্ড: সূর্য চক্রবর্তী, হেমাঙ্গ বসু, মনা দত্ত (অধিনায়ক), মোনা মৌলিক ও নেপাল চক্রবর্তী।

মোহনবাগানের পক্ষে খেলেছিলেন :
গোলে: নৃপেন ভাদুড়ী।
ব্যাক: গোষ্ঠ পাল ও ডাক্তার আর. দাস।
হাফব্যাক: তারক সুর, বলাই চ্যাটার্জি ও সুধাংশু বসু।
ফরওয়ার্ড: এম. ঘোষ, রবি গাঙ্গুলী, পল্টু দাসগুপ্ত, উমাপতি কুমার ও ক্ষেত্র বোস।

রেফারি ছিলেন সি. আর. ক্লেটন। যিনি ছিলেন ক্যালকাটা মাঠের কেয়ারটেকার, তাছাড়া উনি ফুটবল কোচিংও করতেন। সমস্যা ছিল এক জায়গায়, ইংরেজদের টিমের সাথে খেলা থাকলেই ওনার স্বদেশ প্রীতি যেন উপচে পড়তো। তবে আশার কথা এই যে, দুটো স্বদেশী টিম খেললে উনি যথেষ্ট নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেন।

একটা বিষয় উল্লেখ্য, তখন কিন্তু খেলোয়াড় পরিবর্তনের কোনো নিয়ম ছিল না। প্রথম দলে যারা থাকবেন শেষপর্যন্ত তাদেরকেই খেলতে হবে। আহত হয়ে বেরিয়ে গেলে ওনাদের জায়গায় অন্য কেউ নামতে পারবে না, জায়গাটা ফাঁকাই থাকবে।

খেলা শুরুর আগে টস করতে মাঠের মাঝখানে গেলো ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক মোনা দত্ত আর মোহনবাগানের অধিনায়ক গোষ্ঠ পাল। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আগে থেকেই তাদের রণনীতি ঠিক করে নিয়েছিল। খেলার শুরু থেকেই আক্রমণ করার। তখন কোচের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, সিনিয়র প্লেয়াররাই মূলত দল নির্বাচন থেকে রণনীতি..সব ঠিক করতো।

তখন লীগের খেলা হতো ৫০ মিনিটের। ঠিক বিকেল পাঁচটার সময় খেলা শুরু হলো। ইস্টবেঙ্গল কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার আগেই মোহনবাগান আক্রমণ শুরু করে। কুমার আর ক্ষেত্র বোস বেশ কয়েকবার বল দেওয়া নেওয়া করে ইস্টবেঙ্গলের রক্ষণ ভাগের সামনে চলে আসে। যদিও এরপরেই ইস্টবেঙ্গল পরপর আক্রমণ তৈরী করতে লাগলো। সূর্য চক্রবর্তী, মোনা দত্ত আর নেপাল চক্রবর্তী বেশ কয়েকবার আক্রমণ শানায়, কিন্তু তা প্রায় সবই গোষ্ঠ পাল আটকে দেয়। হটাৎই মাঝমাঠে একটা বল ধরে হারান সাহা বেশ কিছুটা এগিয়ে যায়, ওকে আটকাতে পিছন থেকে বলাই ছুটে আসে, হারান সাহা বল বাড়িয়ে দেন সূর্য চক্রবর্তীকে, সূর্য অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় বলটা ধরে কাট করে ঢুকে পড়লো মোহনবাগানের পেনাল্টি বক্সে। কাছেই মোনা দত্ত ওত পেতে বসেছিল। সূর্যের বাড়ানো পাস্ না থামিয়েই চলন্ত বলে শট নিলো গোল লক্ষ্য করে। মোহনবাগানের গোলকিপার নৃপেন ভাদুড়ী ঝাঁপিয়ে পড়লো বল ধরতে। কিন্তু তার আগেই ওর তলা দিয়ে বল গড়িয়ে পোস্টে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। নেপাল চক্রবর্তী খুব কাছাকাছি ছিল,— শুয়ে থাকা গোলকিপার, মোহনবাগানের বাকি দশজন এবং মাঠে ওদের সব সমর্থককে হতবাক করে মোহনবাগানের গোলে বল ঠেলে নেপাল চক্রবর্তী ইস্টবেঙ্গলকে এক গোলে এগিয়ে দিলো। ঘড়িতে তখন ঠিক পাঁচটা বেজে কুড়ি মিনিট।

গ্যালারির চারিদিকে তখন প্রচন্ড উচ্ছাস, এ যেনো এক উৎসব চলছে। এভাবেই প্রথমার্ধ শেষ হলো। বিরতির সময় লেমনেডের পরিমান প্রতিজনের ক্ষেত্রে তিনটের বেশিই হয়ে গিয়েছিলো। আরেকটা বিষয় খুব ভালো হয়েছিল, যেটা, বিরতির সময় খেলা দেখতে আসা শ্রদ্ধেয় কোচ দুখিরাম মজুমদার স্বয়ং গ্যালারি থেকে এসে ইস্টবেঙ্গল প্লেয়ারদের কিছু মূল্যবান পরামর্শও দিয়েছিলেন। আসলে দুখিরাম বাবুর খুব প্রিয় শিষ্য ছিলেন সূর্য চক্রবর্তী, হারান সাহা আর পূর্ণ দাস। সেই বছরই তারা এরিয়ান থেকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যোগদান করেন। তাই প্রিয় শিষ্যেদের খেলা দেখতে দুখিরাম বাবু নিজেই চলে আসেন মাঠে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই মোহনবাগান যেন ফুঁসে উঠলো। তারা বেশ কয়েকটি আক্রমণ তুলে আনলো। সেই মুহূর্তগুলো ইস্টবেঙ্গল কিছুটা অগোছালো হয়ে পড়েছিল। একটা সময় এরকম হয়ে গেলো যেন পূর্ণ দাসেরর বিরুদ্ধে মোহনবাগানের খেলা হচ্ছে। সেদিন পূর্ণ অসাধারণ দক্ষতায় কিছু অবিশ্বাস্য সেভ করেছিল। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা দরকার, অবিশ্বাস্য গোলকিপিং করবার জন্য পূর্ণ দাসকে সেই সময় ‘চাইনিস ওয়াল’ বলে ডাকা হতো। মোহনবাগানের কুমার, পল্টু, রবির বার কাঁপানো শটগুলো পূর্ণ অবিশ্বাস্য শারীরিক দক্ষতায় বুকে জমা করে নিয়েছিল। অবশ্য তার কিছু পরেই ইস্টবেঙ্গল নিজেদের গুছিয়ে নেয়। নেপাল চক্রবর্তীর বাতাসে বাঁকানো কর্নার কিক হেমাঙ্গ বসুর পায়ে পড়তেই চকিতে শট নেয় হেমাঙ্গ। গোষ্ঠ পাল এক্ষেত্রে গোল লাইন থেকে শট বিপদমুক্ত করেন। এপ্রসঙ্গে বলে রাখি নেপাল চক্রবর্তী অসাধারণ কর্নার কিক করতে পারতেন। বহু খেলায় সরাসরি কর্নার থেকে বাঁকানো শটে তিনি গোলও করেছেন। সেইসময় ময়দানে ওর নামই হয়ে যায় “নেপালের কর্নার”। এর মিনিট দুই পরে ননী গোঁসাইয়ের একটা লব, ভলি করতে গিয়ে গোষ্ঠ পাল মিস কিক করেন, কাছেই ছিল মোনা দত্ত। মোনা দত্তর শট নৃপেন ভাদুড়ী কোনোক্রমে প্রতিহত করেন। এভাবে চলতে চলতে খেলা সমাপ্তির লম্বা বাঁশি বেজে যায়। ইস্টবেঙ্গল ১-০ গোলে মোহনবাগানকে কলকাতা লীগের প্রথম পর্বের খেলায় পরাজিত করে। সেই ম্যাচের পর থেকেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এই পাঁচ জন ফরোয়ার্ডের নাম হয়ে যায় “পঞ্চপান্ডব”।

সেদিনের সেই ম্যাচের আজ ১০০ বছর হলো। এখন ফুটবল খেলার অনেক নিয়ম পাল্টে গেছে। সেই সময়ের খালি পায়ে খেলা থেকে আজকের যুগের আধুনিক বুটের ব্যবহার। এতোসব কিছুর পরিবর্তনের পরেও বদলায়নি শুধুমাত্র একটা বিষয়। সেটা হলো সেই পুরোনো রেষারেষি…..সেই “বাঙাল ঘটির লড়াই”। যার মূল সূচনা হয়েছিল মূলত এই খেলার মধ্যে দিয়েই। আর প্রথম সাক্ষাতের সেই জয় দিয়ে আজকের দিনের নিরিখে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আজও তাদের সেই জয়ধ্বজা এগিয়ে নিয়ে চলেছে সফলতার সাথে।

Enable Notifications OK No thanks